ভিটামিন পি এর উৎস এবং এর কাজ সম্পর্কে জেনে নিন
প্রিয় পাঠক, ভিটামিন পি এর উৎস এবং ভিটামিন পি এর কাজ কি সে সম্পর্কে আপনার অনেকেই জানতে চান। আজকে আপনাদের সাথে ভিটামিন পি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। ভিটামিন পি কি আসলে অন্যান্য ভিটামিনের মতো কি না, সে সম্পর্কে জানতে পুরো আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ার অনুরোধ রইল।
পুরো আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা ভিটামিন পি এর উৎস কি সে সম্পর্কে জানতে পারবেন। তাছাড়া আপনার আরো জানতে পারবেন ভিটামিন পি এর কাজ কি, ভিটামিন পি এর রাসায়নিক নাম কি, ভিটামিন পি কে আবিষ্কার করেন, ভিটামিন পি এর অভাবে কি রোগ হয় এবং ভিটামিন পি কাদের জন্য বেশি উপকারী সে সম্পর্কে বিস্তারিত।
ভিটামিন পি কি :
ভিটামিন পি এমন এক ধরনের উপাদান যা উদ্ভিজ্জ রঙিন ফলমূল ও শাক সবজিতে বেশি থাকে। এটি ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক অনু যা ফ্ল্যাভোনয়েড নামে পরিচিত।উদ্ভিদের দেহে বিশেষ কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ থাকে তাকে ফ্ল্যাভোনয়েড বলে।
যা একসময় ভিটামিন পি নামে পরিচিত ছিল। এটি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং রক্তনালীকে শক্ত করতে সাহায্য করে। সবচেয়ে ভালো ভিটামিন পি এর উৎস সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, লেবু, কমলা লেবু,জাম্বুরা ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে।
ভিটামিন পি এর রাসায়নিক নাম কি:
অন্যান্য ভিটামিন যেমন ভিটামিন এ, বি, সি ইত্যাদির মত ভিটামিন পি ও একটি ভিটামিন বলে অনেকে মনে করেন। প্রথমে এটি ভিটামিন পি নামে পরিচিত হলেও বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা একে একক কোন ভিটামিন হিসেবে গণ্য করেনি। ভিটামিন পি এর রাসায়নিক নাম বায়োফ্ল্যাভোনয়েড ( bioflavonoid)। তবে এর একটি সাধারণ যৌগ হলো রুটিন। এটি একটি উদ্ভিজ্জ যৌগ যা ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা বাড়াতে করে।
ভিটামিন পি কে আবিষ্কার করেন :
১৯৩০ এর দশকে সাইট্রাস জাতীয় ফল কমলালেবু থেকে প্রথম বিজ্ঞানী আলবার্ট সেন্ত জিওর্জি এবং তার সহকর্মীরা এক হলুদ রংয়ের পদার্থ বের করেন যা ভিটামিন পি নামে পরিচিত। আলবার্ট সেন্ত জিওর্জি ভিটামিন সি আবিষ্কার করেন এবং ১৯৩৭ সালের নোবেল পুরস্কার পান।
রুটিন নামক এই ফ্ল্যাভোনয়েড এর ওপর গবেষণা করে দেখা যায় যে এই যৌগগুলো অপরিহার্য নয় এবং ভিটামিন এর সংজ্ঞা পূরণ করে না। তাই এটি কোন একক ভিটামিন নয়। যা পরবর্তীতে ফ্ল্যাভোনয়েড নামে পরিচিত।
ভিটামিন পি এর উৎস:
প্রিয় পাঠক, ভিটামিন পি অন্যান্য ভিটামিনের মতো ভিটামিন না হলেও এর বিশেষ কার্যকারিতার জন্য এটি পরিচিত।ভিটামিন পি এর উৎস সম্পর্কে আপনার অনেকেই জানতে চান। ভিটামিন পি এর কিছু প্রাকৃতিক উৎস রয়েছে যা নিচে আলোচনা করা হলোঃ
- ভিটামিন পি এর প্রধান উৎস হলো সাইট্রাস জাতীয় ফল। যেমন কমলালেবু, লেবু, মাল্টা, জাম্বুরা ইত্যাদি। এই ফলগুলোর খোসা সাদা অংশ এবং ঝিল্লিতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে।
- ভিটামিন পি এর আরেকটি ভালো উৎস হল বেরি জাতীয় ফল। যেমন ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ক্র্যানবেরি ইত্যাদি এই জাতীয় ফলে ফ্ল্যাভোনয়েড সমৃদ্ধ যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সুরক্ষা দেয়।
- চা (বিশেষ করে কালো চা এবং গ্রিন টি) তে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে যা আমাদের শরীরে ভিটামিন পি সরবরাহ দেয়।
- রঙিন শাকসবজি ভিটামিন পি এর আরেকটি ভালো উৎস। যেমন লাল বাঁধাকপি বেগুনি বেগুন, বিটরুট,লালশাক ইত্যাদিতে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে।
- বিশেষ করে লাল রঙের আপেল ও আঙ্গুরে কুয়েরসেটিন থাকে। আপেলের খোসা ও মজ্জায় ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে।
- পেঁয়াজ লাল বা হলুদ যাই হোক না কেন এটি কুয়েরসেটিনের খুব ভালো উৎস।
- টমেটো, ব্রোকলি, গাজর ইত্যাদি রঙিন সবজিতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে।
- অলিভ তেল বা জলপাই তেলে ফ্ল্যাভোনয়েডের ভালো উৎস।
- বকউইট এটি রুটিন এর খুব ভালো একটি উৎস।বকউইট থেকে তৈরি আটা এবং খাবার ভিটামিন পি এর উৎস।
- ড্রাগ চকলেট এবং কোকো তে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে যা হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর জন্য বেশ উপকারী।
ভিটামিন পি এর কাজ কি :
প্রিয় পাঠক,উপরের অংশে ভিটামিন পি এর উৎস সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি। আপনারা অনেকে ভিটামিন পি এর কাজ কি এবং এটি আমাদের শরীরে কি কি ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে জানতে চান। আর্টিকেলের এই অংশে আমরা ভিটামিন পি এর কাজ সম্পর্কে আলোচনা করব।
ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে:
ভিটামিন পি আমাদের শরীরে ভিটামিন সি এর ব্যবহার ও শোষণ বাড়ায়। ভিটামিন সি এর অভাবে যে সকল রোগ হয় এ সকল রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
ব্যথা কমায় :
শরীরের যেকোনো ধরনের ফোলা ভাব, ব্যথা, গাঁটের ব্যথা, কোমরের ব্যথা ইত্যাদি উপশমে ভিটামিন পি অর্থাৎ ফ্ল্যাভোনয়েড বেশ কার্যকর।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে :
ফ্ল্যাভোনয়েড আমাদের শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল বিষাক্ত জীবাণু থেকে রক্ষা করে। যা বয়সজনিত ক্ষয়, হৃদরোগ ও স্নায়ুবিক রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা:
ফ্ল্যাভোনয়েড উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, কোলেস্টেরল কমায়, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
ত্বক চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে :
ফ্ল্যাভোনয়েড আমাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং বয়সের ছাপ দূর করে। ত্বক রুক্ষ ও শুষ্ক থেকে বিরত রাখে। তাছাড়া এটি চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায় :
নিয়মিত ভিটামিন পি যুক্ত খাবার খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। নিয়মিত ফ্ল্যাভোনয়েড জাতীয় খাবার টাইপ টু ডায়াবেটিসে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে :
ভিটামিন-পি অর্থাৎ ফ্ল্যাভোনয়েড মস্তিষ্কের চাপ কমাতে সাহায্য করে, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে এবং মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে :
যেহেতু ভিটামিন পি ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা বাড়ায় সেহেতু আমাদের শরীরে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করে এবং রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে।
চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে :
ফ্ল্যাভোনয়েড আমাদের চোখের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। চোখে রক্ত চলাচল সহজ করে এবং চোখে ঝাপসা দেখা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
প্রিয় পাঠক, ভিটামিন পি এর কাজ কি সে সম্পর্কে অবশ্যই এতক্ষণে আপনারা জানতে পেরে। আমাদের শরীরের নানা ভিটামিনের প্রয়োজন তার মধ্যে ভিটামিন পি বা ফ্ল্যাভোনয়েড গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সকলেরই ভিটামিন পি এর উৎস সম্পর্কে জানা উচিত এবং সে সকল খাবার খাওয়া উচিত। তাহলে আমাদের শরীরে ভিটামিন পি এর অভাব পূরণ হয় এবং আমরা সুস্থ থাকতে পারি।
ভিটামিন পি এর অভাবে কি রোগ হয় :
ভিটামিন পি এর অভাবে বড় কোন রোগ না হলেও শারীরিক নানান জটিলতা দেখা দেয়। এই ভিটামিনের অভাবে ভিটামিন সি এর অভাবজনিত লক্ষণ গুলো বিশেষ করে দেখা যায়। নিচে ভিটামিন পি এর অভাবে কি রোগ হয় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
- ভিটামিন পি এর অভাবে রক্তনালী ফেটে গিয়ে রক্তপাত হওয়া, রক্ত জমাট না বাধা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
- তাছাড়া যে সকল রোগীদের আর্থ্রাইটিস রয়েছে তাদের শরীরের ব্যথা,গাঁটের ব্যথা, কোমরের ব্যথা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে।
- ভিটামিন পি এর অভাবের দাঁত ও দাঁতের মাড়ির ব্যথা এবং স্কার্ভির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- ভিটামিন পি এর অভাবে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ভিটামিন পি এর অভাবে ত্বক উজ্জ্বলতা হারায় এবং ত্বকে বয়সের ছাপ পরিলক্ষিত হয়।
- ফ্ল্যাভোনয়েড এর অভাবে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ভিটামিন পি এর অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ফলে ঘনঘন সর্দি, কাশি, জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ভিটামিন পি কাদের জন্য বেশি উপকারী :
ভিটামিন পি প্রায় সকল বয়সের মানুষের জন্য উপযোগী। তবে নির্দিষ্ট কিছু বয়স এবং শারীরিক অবস্থায় ভিটামিন-পি বিশেষভাবে কার্যকর। যেমন ৫০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে বয়সের ব্যক্তির চোখের সমস্যা,রক্তনালী দুর্বল এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে তাদের জন্য ভিটামিন-পি অত্যন্ত উপকারী।
তাছাড়া তারুণ্য ধরে রাখতে এবং বয়সের ছাপ রোধ করতে ভিটামিন পি এর কোন জুড়ি নেই। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ভিটামিন-পি রক্তনালীকে শক্ত রাখে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্কে সজীবতা এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে ভিটামিন পি বা ফ্ল্যাভোনয়েড।
বিশেষ করে যে সকল শিশু বা কিশোরদের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে এবং রক্ত সহজে জমাট বাঁধে না তাদের জন্য ভিটামিন পি অত্যন্ত জরুরী। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ভিটামিন পি খুব ভালো কাজ করে।এটি ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং ডায়াবেটিসজনিত কারণে চোখের রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যারা ধূমপান করে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে তাদের জন্য ভিটামিন পি শরীরের দূষণ ও টক্সিন থেকে রক্ষা করে।
তাই স্বাস্থ্য সচেতন পরিবারে দৈনিক খাদ্য তালিকায় এমন খাবার রাখুন যা ভিটামিন পি এর উৎস। শুধু ভিটামিন পি না সকল ধরনের ভিটামিন আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কোন কোন খাবারে কি কি ভিটামিন আছে তা জেনে নেওয়া এবং সে অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করা প্রত্যেকের দায়িত্ব।
লেখকের মন্তব্য : ভিটামিন সি এর উৎস এবং এর কাজ
প্রিয় পাঠক, আশা করি এতক্ষণে পুরো আর্টিকেলটি পড়ে ভিটামিন পি এর উৎস এবং এর কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পেয়েছেন। যদিও এটি অন্যান্য ভিটামিনের মত নয় তারপরও এর কার্যকারিতা ব্যাপক।ভিটামিন পি এর প্রাকৃতিক উৎস গুলো সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি।
নিয়মিত ভিটামিন পি যুক্ত খাবার খেলে শরীরের কি কি বিশেষ উপকারিতা হয় সে সম্পর্কেও আমরা আলোচনা করেছি। ভিটামিন পি এর কাজ কি সে সম্পর্কেও আপনারা জানতে পেরেছেন। এতক্ষণ মূল্যবান সময় দি আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
এরকম বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য পেতে নিয়মিত আমাদের এই ওয়েবসাইটে ভিজিট করার অনুরোধ রইলো। আর্টিকেলটি সম্পর্কে আপনার বিশেষ কোনো মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url